নকিয়া, এককালের মোবাইল ফোন বাজারের একাধিপতি, ৩৩১০ কিংবা ১১১০ এর মতো বেস্ট সেলিং মোবাইলের জন্ম দেওয়া এই কোম্পানিটি হঠাৎ এন্ড্রয়েড আর আইফোনের সাথে পাল্লা দিতে না পেরে হারিয়ে গিয়েছিলো। ২০১১-১২ মৌসুমে বিশ্বের বড় সব শেয়ারবাজারে ধ্বস নামে নকিয়ার শেয়ারের। তল্পিতল্পা গুটিয়ে নিতে থাকা নকিয়া তার মোবাইল ফোনের ব্যবসাটিও শেষ পর্যন্ত বিক্রি করে দেয় মাইক্রোসফট এর কাছে। নকিয়া ধীরে ধীরে নেটওয়ার্কিং সহ অন্যান্য ব্যবসায় মনোযোগ দেয়। তারপর কেটে গেছে অনেক বেলা। নকিয়ার দখলে থাকা উন্নয়নশীল দেশের বাজার স্যামসাংয়ের মতো কোম্পানিগুলো দখল করে নেওয়ায় নকিয়া আবারও ফিরে আসবে এই চিন্তা অনেকের কাছেই ছিলো নিছক কল্পনা।
কিন্তু সেই নকিয়া ঠিকই ফিরে এলো মোবাইল ফোনের ইতিহাসের অন্যতম বেস্ট সেলিং মোবাইল ‘নকিয়া ৩৩১০’ আবার বাজারে আনার ঘোষণা দিয়েই। ২০০০ সাল এবং সমসাময়িক প্রজন্মের মনে স্মৃতিকাতরতার জন্ম দেওয়া এক মোবাইল ফোন এই নকিয়া ৩৩১০।
২০০০ সালের ১ সেপ্টেম্বরে বাজারে আসে নকিয়া ৩৩১০। স্নেক গেম আর দীর্ঘস্থায়ী ব্যাটারি লাইফ দিয়ে ব্যবহারকারীদের মনে জায়গা করে নেয় এটি। ১৩৩ গ্রাম ওজনের শক্ত মজবুত এই মোবাইল ফোনটিই সর্বপ্রথম সাধারণের সাধ্যের মধ্যে প্রথম মোবাইল ফোন যেটিতে ব্যবহার করা হয়েছিলো ইন্টারনাল এন্টেনা সিস্টেম। এই মোবাইলের বদৌলতে এসএমএস বা শর্ট মেসেজিং সার্ভিস ব্যবহারকারীদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠে। তাই নকিয়া ৩৩১০ মোবাইল ফোনটিকে অনেকে সময়ের চেয়ে একটু এগিয়ে রেখেছিলেন।
সাধ্যের নাগালে থাকা এক মোবাইল ফোনকেই ক্যালকুলেটর, স্টপ ওয়াচ, এলার্ম ঘড়ি কিংবা অবসরে গেম খেলার যন্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা যাবে- ২০০০ সালের দিকে এই ধারণাটি উন্নয়নশীল আর স্বল্পোন্নত দেশের মানুষের কাছে অনেকটা কল্পনাই ছিলো। তাইতো ২০০৫ সালে এই মডেলটি বাজার ছাড়ার পর বিক্রি হয় ১২৬ মিলিয়ন ইউনিট। যার বেশিরভাগই ছিলো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। জনপ্রিয় দৈনিক টেলিগ্রাফের করা এক জরিপে সর্বকালের বেশি বিক্রি হওয়া ২০টি মোবাইলের একটি এটি। টেলিগ্রাফের জরিপ অনুসারে এই মোবাইল মানুষের মনে তার ‘স্নেক গেম’ আর ‘মনোফোনিক রিংটোন’ দিয়েই আসন গেড়ে নিয়েছিলো। ৩৩১০ মডেলের পরে নকিয়া এই মডেলের অনুরূপ অনেকগুলো মোবাইল সেট বাজারে আনে। ২০০৩ সালে নকিয়া বাজারে আনে ১১১০ মডেলটি। ২০০৯ সালে নকিয়া ১১১০ বাজার ছাড়ার আগে বিক্রি হয়েছে ২৫০ মিলিয়ন ইউনিট। বার্তাসংস্থা রয়টার্স এর মতে এই ১১১০ স্থান করে নিয়েছে বিশ্বে সর্বাধিক বিক্রি হওয়া ইলেক্ট্রনিক পণ্য হিসাবে। ফিনল্যান্ডের এই প্রযুক্তিপণ্য নির্মাতা প্রতিষ্ঠান নকিয়া তখন ফিচার ফোন ব্যবসার তুঙ্গে।
১৮৬৫ সালে নকিয়া প্রতিষ্ঠা হবার পর থেকেই এই কোম্পানির ব্যবসায় ছিলো বহুমাত্রিকতা। নকিয়ার ব্যবসার হাতেখড়িটা ছিলো কাগজের কারখানা দিয়ে। তারপর নকিয়া নিজেদের বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী এবং সরবরাহকারী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে। ১৯৬৭ সালে নকিয়া কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭০-এর দশকে নকিয়া নেটওয়ার্কিং আর রেডিও ব্যবসা শুরু করে। ১৯৮২ সালে নকিয়া তাদের প্রথম মোবাইল ফোন বাজারে ছাড়ে। সেটি ছিলো মূলত একটি কার ফোন, যেটির নাম ছিলো ‘Mobira Senator’.
বর্তমান বিশ্বে মোবাইল সিমকার্ড ভিত্তিক যে নেটওয়ার্কটি ব্যবহৃত হয় সেটি GSM বা ‘Global System for Mobile Communications’ নামে পরিচিত। এর উন্নয়নের পেছনে অবদান আছে নকিয়ার। ১৯৮০-এর দশকে নকিয়া আর সিমেন্স মিলেই বিশের প্রথম GSM নেটওয়ার্ক চালু করে। GSM নেটওয়ার্ক আর নকিয়ার হার্ডওয়্যার ব্যবহার করে বিশ্বের প্রথম কলটি করেন তৎকালীন ফিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী Harri Holkeri.
নভেম্বর, ১৯৯২ সালে নকিয়া বাজারে নিয়ে আসে ‘নকিয়া ১০১১’। মূলত এই মোবাইলের মাধ্যমে ফিনল্যান্ড সহ বিশ্ববাজারে ব্যাপক পরিচিতি পায় নকিয়া। ১৯৯৮ সালে নকিয়া তাদের প্রতিযোগী মোবাইল ফোন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ‘মটোরলা’ কে ছাড়িয়ে যায়। ২০০০ সালের পর নকিয়া একের পর এক বাজারে আনে ৩৩১০, ১১১০ এর মতো বেস্ট সেলিং মোবাইল সেটগুলো। ২০০২ সালে নকিয়া বাজারে আনে তাদের প্রথম ক্যামেরাসংযুক্ত মোবাইল ফোন। ০.৩ মেগাপিক্সেল ক্যামেরাবিশিষ্ট এই মোবাইল ফোন বাজারে বেশ সাড়া ফেলে।
২০০৭-০৮ মৌসুমে বাজারে আসতে শুরু করে এন্ড্রয়েডচালিত স্মার্টফোন, অন্যদিকে আইফোনও তার নিজস্ব অপারেটিং সিস্টেমচালিত স্মার্টফোন। প্রতিযোগিতায় তাল মিলাতে হিমশিম খেয়ে যায় নকিয়া। প্রথমে নকিয়ার নিজস্ব অপারেটিং সিস্টেম ‘সিম্বিয়ান’ এবং পরে মাইক্রোসফটের অপারেটিং সিস্টেমে স্মার্টফোন বাজারে আনে নকিয়া।
মাইক্রোসফটের অপারেটিং সিস্টেমে নির্মিত প্রথম স্মার্টফোন ‘লুমিয়া ৮০০’ বাজারে তেমন সাড়া ফেলেনি। ২০১১-১২ মৌসুমে নকিয়ার পতন শুরু হয়। শেয়ারবাজারে নকিয়ার শেয়ারের দাম পড়তে শুরু করে। ২০১২ সালের শেষের দিকে নকিয়ার শেয়ারের দাম দাঁড়ায় ২ ডলারে। সর্বস্বান্ত হবার দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়ায় নকিয়া। ২০১৩ সালে নকিয়ার স্মার্টফোন ব্যবসার পুরোটা ৭.১৭ বিলিয়ন ডলারে কিনে নেয় মাইক্রোসফট। নকিয়ার প্রধান নির্বাহীসহ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা যোগদান করেন মাইক্রোসফটে।
অনেকেই ভেবেছিলো নকিয়ার বোধহয় এখানেই শেষ। আর মাথা তুলে দাঁড়াতেই পারবে না নকিয়া। কিন্তু মাইক্রোসফটের কাছে মোবাইল ব্যবসা বিক্রি করে দিয়ে নকিয়া মন দিয়েছিলো তাদের পুরনো সেই নেটওয়ার্কিং এর ব্যবসায়। সিমেন্সকে ২.২ বিলিয়ন ডলারে কিনে আবার ‘নকিয়া নেটওয়ার্কস’ নামে যাত্রা শুরু করে। ২০১৪ সালে মাইক্রোসটের সাথে চুক্তি শেষে নকিয়া ২০১৭ নাগাদ আবারো স্মার্টফোন ব্যবসায় আসার ঘোষণা দেয়।
২০১৬ সালে নকিয়া ‘HMD Global’ নামে ফিনল্যান্ডের এক প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়। HMD Global মূলত এখন থেকে নকিয়ার স্মার্টফোন আর ফিচার ফোন বানানোর কাজটি করবে। তবে এই প্রতিষ্ঠানটি নকিয়া ৩৩১০-কে আবারে বাজারে ফিরিয়ে আনার ঘোষণা দিয়ে বেশ সাড়া ফেলে। ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ বার্সেলোনাতে ওয়ার্ল্ড মোবাইল কংগ্রেসে ৪৯ ইউরো দামের নতুন এই নকিয়া ৩৩১০ ফোন বাজারে আনে এই প্রতিষ্ঠানটি।
নতুন এই নকিয়া ৩৩১০ স্পেসিফিকশনের দিক দিয়ে পুরাতন ৩৩১০ কে ছাড়িয়ে যাবে তা বলাই বাহুল্য। ব্যাটারিতে নতুন এই ফোন একবার ফুল চার্জ দিয়ে ২২ ঘন্টা কথা বলা যাবে! থাকছে দুই মেগাপিক্সেল এর ক্যামেরা, মাইক্রোএসডি কার্ড স্লট। পুরাতন ৩৩১০ এর মতোই চলবে 2G নেটওয়ার্কে। তবে এতে যোগ হচ্ছে ওয়াইফাই, ব্লুটুথ, জিপিএস এর মতো সেবা। বাজারে লাল আর হলুদ দুই রঙের পাশাপাশি পুরাতন নকিয়া ৩৩১০ এর রঙে ও পাওয়া যাবে খুব শীঘ্রই।
ডিসপ্লেতেও যোগ হয়েছে কালার। আকারেও বড় হচ্ছে খানিকটা। সবকিছু বাড়লেও কমছে ওজন, এককালের ১৩৩ গ্রাম ওজনের শক্তপোক্ত নকিয়া ৩৩১০ এর বর্তমান ওজন দাঁড়িয়েছে ৭৯.৬ গ্রাম। থাকছে মানুষের মনে স্মৃতিকাতরতার জন্ম দেওয়া সেই ‘স্নেক গেইম’। তবে এই গেইমের আধুনিকায়নে বেশ মনোযোগী হয়েছে নকিয়া। এমনকি স্নেক গেমের কিছু আধুনিক ভার্সন এন্ড্রয়েডচালিত স্মার্ট ফোনের জন্য আনতে যাচ্ছে নকিয়া।
শুধু ৩৩১০ এর মতো ফিচার ফোনই নয়, নকিয়ার লক্ষ্য এখন এন্ড্রয়েডচালিত স্মার্টফোনের দিকে। অনেক বাজার বিশ্লেষকের মতে নকিয়ার হারিয়ে যাবার অন্যতম কারণ ছিলো এন্ড্রয়েড প্ল্যাটফর্মে স্মার্টফোনে না বানানোর সিদ্ধান্তটি। তাই এবার আর কোনো হেলাফেলা নয়।
নকিয়া ৩, নকিয়া ৫, নকিয়া ৬ নামের তিনটি এন্ড্রয়েডচালিত স্মার্টফোন বাজারে আনার ঘোষণা দিয়েছে নকিয়া। মানসম্মত প্রোডাক্ট দিয়ে নকিয়া আবারও বাজারে ফিরবে এমনটাই প্রযুক্তি জগতের সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের আশা।