প্রত্যেক শিক্ষিত মানুষের জন্য অন্যতম বড় সিদ্ধান্ত বা চ্যালেঞ্জ হলো পেশা নির্বাচন করা অথবা ক্যারিয়ার ঠিক করা! অর্থাৎ কীভাবে তিনি তাঁর জীবন অতিবাহিত করবেন বা কোন পেশায় যাবেন তা ঠিক করা। কারণ, বসে বসে দিন অতিবাহিত করার সুযোগ বর্তমানে নেই। তবে বিভিন্ন রকমের পেশা আমরা দেখতে পাই। যেমন রাজনীতি, ব্যবসা, চাকরি, বিদেশ গমন, সাংবাদিকতা, শিক্ষকতা ইত্যাদি। মানুষ সাধারণত একটি পেশা নির্বাচনের সুযোগ পেয়ে থাকেন। আবার সবাই কিন্তু একই ধরনের পেশায় যাবেন না বা পছন্দও করবেন না। যেমন কারও কাছে ব্যবসা অনেক প্রিয় একটি কাজ। কেউ আবার বলবেন, ব্যবসায় অনেক ঝুঁকি আছে আমি বরং চাকরিতেই যাই। এর দ্বারা যেটা প্রমাণিত হয় তা হলো, সব মানুষের কাছে সব পেশা ভালো লাগবে না। এটা স্বাভাবিকও। এখন যাঁরা চাকরি করতে চান তাঁদের মধ্যে আবার দুটি ভাগ আছে। কেউ সরকারি চাকরি চান; কেউবা বেসরকারি চাকরি চান। আবার সরকারি চাকরি যাঁরা চান তাঁদের মধ্যেও দুইটা ভাগ আছে। কেউ ক্যাডার সার্ভিসে যেতে চান; কেউবা নন-ক্যাডার সার্ভিসে। এসব বৈচিত্র্য আমাদের মেনে নিতেই হবে।
ক্যারিয়ার প্ল্যানিংয়ের গুরুত্ব
ইংরেজিতে একটা কথা আছে, “A good plan is half-done.” অর্থাৎ সুন্দর একটি পরিকল্পনা করতে পারলে তা অর্জনের পথে অর্ধেক এগিয়ে যাওয়া যায়। কথাটি ঠিক তাই। আর এ কথা ক্যারিয়ার প্ল্যানিংয়ের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যথাসময়ে সঠিক পন্থায় ক্যারিয়ার প্ল্যানিং করতে না পারলে অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত হতে হয়। এখন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগ। খুব সহজে যেকোনো বিষয়ে তথ্য আহরণ করা যায়। তাই সবকিছু জেনে ঠিক করা উচিত আপনি কী করবেন! এখানে একটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ, অতি দ্রুত সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করবেন না। যেমন আপনি আজ ঠিক করলেন চাকরি করবেন। কিন্তু দুই মাস পর বললেন, ব্যবসা করবেন। এতে আপনার সময় ও মেধার অপচয় হবে। যথাসময়ে না ভাবলে আপনার বড় ক্ষতিও হতে পারে। একটা সত্য ঘটনা বলি। আমার এক পরিচিত ক্যাডার সার্ভিসে যোগদান করল প্রায় ৩০ বছর বয়সে। কারণ, সে সচেতন ছিল না। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে তার এক জুনিয়র তার আগেই একই পেশায় যোগদান করে। রীতি অনুযায়ী জুনিয়রকে তার স্যার বলতে হয় যা অনেক সময় বিব্রতকর। এখানে আরেকটি বিষয়ও আছে। নিয়ম অনুযায়ী ৫৯ বা ৬০ বছর হলে অবসরে যেতে হয়। যদি আপনি দেরিতে চাকরিতে যোগদান করেন, তবে আপনি কম সময় চাকরি করার সুযোগ পাবেন। তাই যথাসময়ে সিদ্ধান্ত নিন কী করতে চান।
কেন সিভিল সার্ভিস
যতগুলো পেশা আছে তার মধ্যে অনেকেরই স্বপ্ন থাকে বিসিএস ক্যাডার হওয়ার। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এখন আমি যে বিষয়গুলো আলোচনা করব তা প্রধানত ক্যাডারপ্রত্যাশীদের জন্য। কারণ, সবাই ক্যাডার হতে চায় না বা হওয়ার দরকারও নেই অথবা সুযোগও নেই। যা বলছিলাম। বাংলাদেশের অন্যতম সম্মানিত পেশা হলো বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস। বর্তমানে জেনারেল ও টেকনিক্যাল বা পেশাগত ক্যাডার মিলিয়ে মোট ২৭টি ক্যাডার আছে। জেনারেল ক্যাডারগুলো সবার জন্য উন্মুক্ত। যে কেউ আসতে পারেন। তবে টেকনিক্যাল ও পেশাগত ক্যাডারের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট বিষয়ে পড়াশোনা থাকতে হয়। একটা কথা বলা প্রয়োজন, ক্যাডার চয়েসের ক্ষেত্রে আপনার যা ভালো লাগে তা ঠিক করুন। কারণ, চাকরিটা আপনি করবেন। আপনার পছন্দেরও একটা দাম আছে। যা হোক প্রতিনিয়ত ক্যাডার সার্ভিসের প্রতি শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর চাহিদা বাড়ছে। এর কয়েকটা কারণও আছে। যথা—
ক) এখানে দেশ ও দশের সেবা করার সুযোগ তুলনামূলকভাবে বেশি।
খ) চাকরির নিরাপত্তা আছে। বিশেষ কিছু কারণ ছাড়া চাকরিচ্যুত হওয়ার ভয় নেই।
গ) উচ্চশিক্ষার সুযোগ অনেক বেশি। ৫ বছরের শিক্ষা ছুটি নেওয়া যায়।
ঘ) বেতন ও সুযোগ-সুবিধা বেড়েছে। চাকরি শেষে রয়েছে বিশাল পেনশন।
ঙ) ৫ বছরের জন্য লিয়েন নেওয়ার ব্যবস্থা আছে।
চ) প্রশিক্ষণ ও দাপ্তরিক কাজে বিদেশ সফর করার সুযোগ আছে।
ছ) বর্তমান সমাজব্যবস্থায় বেশ সামাজিক মর্যাদাও আছে।
জ) রাষ্ট্র পরিচালনায় সরকারের সঙ্গে সরাসরি অংশ নেওয়ার সুযোগ আছে।
ঝ) গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়।
সব মিলিয়ে অনেকেই এখন সিভিল সার্ভিসে আসতে চান।
কী করবেন
এবার আসুন যাঁরা সিভিল সার্ভিসে আসতে চান তাঁদের কীভাবে নিজেকে ধীরে ধীরে তৈরি করা উচিত। আমি ধরে নিলাম, আপনি অনার্স প্রথম বর্ষে আছেন এবং হৃদয়ে ক্যাডার হওয়ার স্বপ্ন লালন করেন। যা করবেন…
ক) আপনার নিজ বিভাগের পড়াশোনার ওপর নির্ভর করবে আপনি কতটুকু সময় বিসিএসকে দেবেন। আপনি যদি খুব ব্যস্ত বিভাগের শিক্ষার্থী হন, তবে সময় কম দেবেন।
খ) আপনার বর্ষের ওপর নির্ভর করবে বিসিএস প্রস্তুতির গতি। প্রথম বর্ষের গতির চেয়ে চতুর্থ বর্ষের গতি অবশ্যই বেশি হবে।
গ) নিজ বিভাগকেও অবহেলা করবেন না। পর্যাপ্ত সময় সেখানেও দেবেন। বাজে কাজে সময় নষ্ট না করলে আশা করি ভালো সময়ই পাবেন।
ঘ) বিসিএসে বিভাগের সিজিপিএরও গুরুত্ব আছে। এটা ভাইভাতে কাজে দেবে। তবে শুধু সিজিপিএ দিয়েও বিসিএস হবে না। ৩.০০–এর মতো থাকলেই আর অসুবিধা হয় না। আর বেশি থাকলে তো ভালোই।
ঙ) জাতীয়, পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে তেমন বৈষম্য করা হয় না। কারণ, কর্তৃপক্ষ আপনাকে বিচার করবে; বিশ্ববিদ্যালয় নয়। তাই হতাশ বা বেশি খুশি হওয়ার প্রয়োজন নেই।
চ) প্রথম বর্ষে থাকতেই বিসিএসের প্রিলিমিনারি, লিখিত ও ভাইভার সিলেবাসটা খুব ভালো করে পড়ে নেবেন। এতে কোন ধরনের বিষয় অন্তর্ভুক্ত, তা বুঝে আগাতে পারবেন।
ছ) প্রথম বর্ষের শেষের দিকে বিগত বিসিএসের প্রশ্নগুলো বিশেষ করে প্রিলির প্রশ্ন ব্যাখ্যাসহ পড়বেন। লিখিত প্রশ্নগুলো দেখবেন।
জ) দ্বিতীয় বর্ষে যখন আসবেন তখন বেসিক বই বিভাগের ফাঁকে ফাঁকে পড়বেন। যেমন বাছাই করে ক্লাস সিক্স টু টেন বোর্ডের বই। উচ্চমাধ্যমিকের কম্পিউটার ও পৌরনীতিও পড়বেন। অবশ্যই ধীরে ধীরে ও বুঝে বুঝে পড়বেন।
ঝ) সম্ভব হলে একাডেমিক কোচিংয়ে পড়ান বা টিউশন করান। সেটা একটি বা দুটি। বাংলা, বিজ্ঞান, ইংরেজি ও গণিত পড়ান। নিজেরও কাজে লাগবে। সঙ্গে সঙ্গে কথা বলার জড়তা কাটবে, যা ভাইভায় কাজে লাগবে।
ঞ) তৃতীয় বর্ষে এসে কিছু মৌলিক বই পড়ে নিন। যেমন ১. অসমাপ্ত আত্মজীবনী (শেখ মুজিবুর রহমান) ২. বাংলাদেশের ইতিহাস (১৯০৫-১৯৭১) [ড. আবু মো. দেলোয়ার হোসেন] ৩. লাল নীল দীপাবলি (ড. হুমায়ুন আজাদ) ৪. বিশ্বরাজনীতির ১০০ বছর (ড. তারেক শামসুর রেহমান) ইত্যাদি।
ট) চতুর্থ বর্ষের প্রথম থেকে প্রিলির জন্য বিষয় ধরে গাইড পড়া শুরু করুন। প্রতিটি বিষয়ের জন্য একটি করে গাইড হলেই যথেষ্ট।
ঠ) পাশাপাশি পূর্বে যে বইগুলো পড়েছেন, তা থেকে গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো চতুর্থ বর্ষে এসে রিভিশন দেবেন।
ড) লিখিত ও ভাইভার জন্য যে তথ্যগুলো দরকার, তা আপনি বেসিক বইগুলোতে পড়ে এসেছেন।
ঢ) এরপর লিখিত ও ভাইভার সময় বিষয়ভিত্তিক কিছু গাইড সংগ্রহ করে নেবেন। আর মৌলিক বই তো পড়া আছেই।
ণ) সাধারণ জ্ঞানের বিষয়গুলো একটু পরে পড়া উত্তম। কারণ, তা অনেক পরিবর্তিত হয়।
ত) যা পরিবর্তিত হয় না যেমন বিজ্ঞান, গণিত, ইংরেজি আপনি প্রথম বর্ষ থেকেই নোট করতে পারেন।
থ) কোনো বিষয়ে দুর্বল থাকলে তা প্রথম থেকেই ভালো করে পড়া উচিত। যেমন গণিত ও ইংরেজিতে অনেকেই দুর্বল। আগে থেকে পড়লে এ সমস্যা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।
দ) দৈনিক পত্রিকা পড়ার অভ্যাস করুন প্রথম বর্ষ থেকেই।
ধ) ধীরে ধীরে ইংরেজি শব্দের অর্থও পড়া শুরু করুন। কারণ, তা সহজে আয়ত্তে আনা যায় না।
ন) পড়ার সময় তাড়াতাড়ি বই শেষ করার চেষ্টা করবেন না। বিষয়টির গভীরে ঢোকার চেষ্টা করুন। ধারণা পরিষ্কার থাকলে যেকোনো আকারে লিখতে পারবেন।
এভাবে নিজেকে প্রস্তুত করতে পারলে আশা করি প্রথম বিসিএসেই কাঙ্ক্ষিত ক্যাডার পাওয়া সম্ভব। এতে আপনার ওপর একসঙ্গে অনেক চাপ পড়বে না। তাই ভালো প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব হবে। আর জানেনই তো, “Slow and steady wins the race”. সবার জন্য শুভকামনা।
লেখক: প্রশাসন ক্যাডার (২য় স্থান), ৩৪তম বিসিএস