সফলতার এক অন্যরকম গল্প!

লেখক:
প্রকাশ: ৫ years ago

ছোট্ট একটি দোকান। দুবাইয়ের ফুজাইরা শহরে। গার্মেন্ট শপ। আট হাত বাই ৮ হাতের এ দোকান দিয়েই ব্যবসা শুরু। সঙ্গে স্ত্রী, এক কন্যা। মন্দা ব্যবসা। দিন চলাই ছিল কষ্টের। কোনরকমে টেনেটুনে সংসার চলছিল। এর আগে চাকরি করতেন তিনি। দুবাইয়েরই রকউল ফ্যাক্টরিতে। জুনিয়র সেলস এক্সিকিউটিভ হিসেবে। একটি ফোনেই চাকরি ছেড়ে দেন। হাতে মাত্র ৭০ হাজার টাকা পুঁজি। অনেক ভেবেচিন্তে ব্যবসা দিয়ে বসেন।

দোকানের ডেকোরেশন করতেই বেশির ভাগ টাকা চলে যায়। এখন মালামাল তোলা কঠিন হয়ে পড়ে। যে টাকা ছিল, সে টাকা দিয়েই তিনি কিছু গার্মেন্ট পণ্য দোকানে তোলেন। কিন্তু না, এ ব্যবসা তার দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকাচ্ছে না। ব্যবসা জমছে না। কি করবেন তিনি? নানা চিন্তা তার মাথায়। তবে হতাশ নন। তিনি হতাশ হবার পাত্র নন। লেগে আছেন। এভাবে দিন চলতে থাকে। কষ্টের দিন। ভাবনার দিন। কিছু না পাওয়ার দিন।

এই না পাওয়াই তার জীবনকে ঘুরিয়ে দেয়। জীবনের বাঁকে বাঁকে যার বুকে সাগরের ঢেউ, তিনি হয়ে ওঠেন আনন্দে উদ্বেলিত। আজ তিনি বাংলাদেশের প্রথম সারির একজন শিল্পপতি। ব্যবসায়ী। হাজার কোটি টাকার ব্যবসা তার। তিনি ব্যাংক থেকে লোন নেবেন শুনলে ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তার কাছে গিয়ে হাজির। তিনি যেন তাদের ব্যাংক থেকে টাকা নেন। সততা, নিষ্ঠা আর একাগ্রতা দিয়ে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন সফল মানুষের প্রতিকৃতি হিসেবে।

দেশের হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, দেশে শত হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ ও বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের মাধ্যমে দেশসেবার অভিপ্রায়ে এগিয়ে যাচ্ছেন তিনি। একে একে গড়ে তুলেছেন সিরামিকস, ফার্মাসিউটিক্যালস, ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি, সিকিউরিটি সার্ভিস, টাইলস অ্যান্ড স্যানেটারিওয়্যার, পেইন্টস, পাইলিং, কয়েল কোম্পানি, বিদ্যুৎকেন্দ্র, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া, পরসোলিন, স্পিনিং, প্যাকেজিং এবং কনস্ট্রাকশন কোম্পানিসহ নানা শিল্পকারখানা। যেখানেই হাত দেন সেখানেই ফলে সোনা। দেশের মাটিতে এ সোনা ফলানো কৃষকের গল্প শোনাব আজ।

এ এক অন্যরকম সফলতার গল্প। ১৯৭৭ সালের যে গল্পের শুরু। ২০১৪ সালে এসে আজ এক শিল্পের মহারুহ। নতুন দিগন্ত যাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। আজ নাগর দোলায় দোলে যিনি পৃথিবী দেখছেন। বাংলাদেশ দেখছেন। বিশ্ব দরবারে তার শিল্প প্রতিষ্ঠানের পণ্য নিয়ে গিয়ে বাংলাদেশকে পরিচয় করে দিচ্ছেন। ব্যবসার শুরু ১৯৮৫ সালে দুবাইয়ে। সেই ছোট একটি দোকানের মাধ্যমে। এর সূতিকাগারই ১৯৭৭ সালে। ওই বছর তিনি বিকম পরীক্ষা দেন। কিন্তু কৃতকার্য হতে পারেননি। মন খারাপ। আপসেট হয়ে পড়েন তিনি। এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে চলে যান দেশের বাইরে।

জার্মানিতে। চাকরি নেন। ছোট চাকরি। তাই কোন সুবিধা করতে পারেননি। ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসেন। তখন ১৯৮২ সাল। জার্মানি থেকে ফিরে এলেও তিনি সঙ্গে নিয়ে আসেন সে দেশের মহান শিক্ষা- শ্রমের প্রতি আনুগত্য আর মর্যাদা। কঠিন পরিশ্রম, সময়ের মর্যাদা, নিয়মানুবর্তিতা এবং সত্য বলা। সততা তো আছেই সবার ওপরে। চাকরি বাদ দিয়ে ব্যবসা করবেন এটাই ছিল সিদ্ধান্ত। কিন্তু অর্থাভাবে সে সময়ে তা সম্ভব হয়নি। দেশে আসার পর পরিবার থেকে চাপ আসে বিয়ে করার।

একসময় পরিবারের কথায় বিয়েও করেন। কিন্তু এভাবে বেকার থাকবেন আর কত দিন। স্ত্রীর বোঝাতো নিজে বইতে হবে? বিয়ের পর আবার মনস্থির করেন বিদেশ চলে যাবেন। জার্মানিতেই যাওয়ার ইচ্ছা ছিল তার। কিন্তু কপালে তা ছিল না বলেই তিনি চলে যান দুবাইয়ে। ১৯৮৩ সাল। দুবাইয়ের রকউল ফ্যাক্টরিতে জুনিয়র এক্সিকিউটিভ হিসেবে চাকরি পেয়ে যান। চাকরি করতে থাকেন মনোযোগ দিয়ে।

প্রতিষ্ঠানটি ইউরোপিয়ান ম্যানেজমেন্টে চলত। এটাই হয়তো তার টার্নিং পয়েন্ট। তিনি ওই প্রতিষ্ঠানে যোগ দিয়েই শ্রমের প্রতি আনুগত্য নিয়ে কাজ করতে থাকেন। প্রতিষ্ঠানটি ছিল রুগ্‌ণ। বেতনও কম। তিনি যোগ দেয়ার ক’মাসের মধ্যেই একে টেনে তুলেন তিনি। সবার দৃষ্টি কাড়েন। প্রমোশন হয় তার। জুনিয়র এক্সিকিউটিভ থেকে একেবারে গোটা আবুধাবির ইনচার্জ। দায়িত্ব পেয়ে তিনি আরও জোরে কাজ চালাতে থাকেন। এরই মধ্যে তিনি হন কন্যাসন্তানের জনক। সেখানে কোনরকমে সংসার চালাতে থাকেন তিনি।

দুবাইয়ে সুনাম কুড়ানোর পর তাকে সৌদি আরবেরও দায়িত্ব দেয়া হয়। যে বেতন পান তা দিয়ে সংসার চালানোই কষ্টকর হয়ে পড়ে। তার পরও স্ত্রী-কন্যার দিকে তাকিয়ে তিনি চাকরি করতে থাকেন। না বেশিদূর তিনি যেতে পারেননি। একদিন ফোন করে চাকরি ছেড়ে দেন। সিদ্ধান্ত নেন ব্যবসা করবেন। নিজের মতো করে ব্যবসা সাজাবেন। কিন্তু হাতে তেমন টাকাও নেই। দুবাইয়ের ফুুজাইরা শহরের একটি মার্কেটে ছোট্ট দোকান দিয়ে বসেন। মাত্র ৭০ হাজার টাকা পুঁজি। গার্মেন্টস পণ্যের ব্যবসা। এ ব্যবসা জমাতে পারছেন না।

এরই মধ্যে একদিন ব্যাংকক হয়ে বাংলাদেশে যাচ্ছিলেন তিনি। উদ্দেশ্য ব্যবসার জন্য কিছু পুঁজি বাবা-মায়ের কাছ থেকে আনা। পকেটে তখন ৩০০ ডলার। ব্যাংককে তৈরি পোশাকের দাম দেখে তিনি পুরো ৩০০ ডলার দিয়েই কাপড় কিনে শিপমেন্ট করেন। এটাই তার প্রথম শিপমেন্ট। এই ৩০০ ডলারের কাপড় বিক্রি হয় ১৫০০ ডলার। প্রতিবারই এ রকম লগ্নি করে পুঁজি ৩-৪ গুণ হয়ে ফিরে আসছে। এখন বেশি টাকার মালামাল আমদানি করছেন। লাভও করছেন বেশি। মাসে তখন লাভ হতে থাকে ৩০ থেকে ৪০ হাজার দেরহাম করে। আর ওই সময়ই তার লাইফ স্টাইল পরিবর্তন হতে থাকে।

আল আহলি ট্রেডিং নামে ওই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের শাখাও খুলে বসেন ইউএই-এর বিভিন্ন শহরে। এ সময় তিনি গার্মেন্ট ব্যবসার পাশাপাশি শুরু করেন ডিপার্টমেন্টাল শপ। এ ছাড়া দুবাইয়ে তিনি প্রথম শুরু করেন ভিডিও গেমের ব্যবসা। এ ব্যবসায় তিনি নাম্বার ওয়ান হয়ে যান। চারদিকে তার নাম-ডাক ছড়িয়ে পড়ে। ওদিকে রকউল কোম্পানির সেই বস তাকে ফলো করতে থাকেন। ব্যবসা ভাল দেখে তিনিও খুব খুশি। তার এ বসের নাম ড. খাতের মাসাদ।

এভাবে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত একচেটিয়া ব্যবসা। সুখ বুঝি মানুষের বেশিদিন সয়না। এমনই হয় তার ক্ষেত্রে। শুরু হয় ইরাক-কুয়েত যুদ্ধ। মানুষের মনে আতঙ্ক। ভয়। হঠাৎ ব্যবসা ডাউন হয়ে যায়। সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে ভয়াবহ যুদ্ধ হবে। সব কিছু ধ্বংস হয়ে যাবে। মধ্যপ্রাচ্যজুড়েই শুরু হয় ভয়াবহ ক্রাইসিস। কোন ব্যবসাই চলছে না। কোন ব্যবসা একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। তার ব্যবসাও বন্ধ হয়ে যায়। এভাবে কিছুদিন চলার পর পরিস্থিতি শান্ত হয়। কিন্তু তত দিনে তার ব্যবসার অবস্থা শোচনীয় হয়ে ওঠে। কি করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না।

হঠাৎ তার মনে হলো বস ড. খাতের মাসাদের কথা। ছুটে যান বসের কাছে। বস তার ব্যবসার পার্টনার হন। ফান্ড দেন। কিন্তু ব্যবসায় যে ধস শুরু হলো তাতে আর প্রাণ ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। ব্যবসা সেখানে বন্ধ করে দেন। পার্টনারদের টাকা ফেরত দিয়ে দেন। এভাবেই তার কেটে যায় আরও ৪ বছর। সময়টা ১৯৯৪ সাল। দুবাইতে ব্যবসা শুরু করে আরএকে সিরামিক্স। হ্যাঁ, পাঠক। এতক্ষণে নিশ্চয় বুঝতে পারছেন তিনি কে? তিনি আর কেউ নন, আরএকে সিরামিক্সের এমডি সৈয়দ এ কে একরামুজ্জামান।

দেশের প্রথম সারির একজন শিল্পপতি। ব্যবসায়ী। ব্যবসায় যিনি বাংলাদেশের একজন পথিকৃৎ। যিনি যে ব্যবসায় হাত দিয়েছেন তাতেই হয়েছেন সফল। ব্যর্থতা বলতে তার জীবনে কিছু নেই। তবে জীবনে চলার পথে ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়েই তিনি আজকের এ পর্যায়ে এসেছেন। সমাজসেবায়ও রাখছেন অনবদ্য অবদান। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাসিরনগর উপজেলার চাপড়তলা গ্রামের সৈয়দ কামরুজ্জামানের সন্তান তিনি।

জার্মানি, দুবাই থেকে ব্যবসা নিয়ে এখন বাংলাদেশে একরামুজ্জামান। না দুবাইয়েও রয়েছে তার ব্যবসা। যেখানে তিন শতাধিক শ্রমিক কাজ করছেন। আর এ কারণে তাকে প্রায়ই দুবাই যেতে হয়। আর বাংলাদেশে তার এলাকা নাসিরনগরের দুই সহস্রাধিক লোক তার প্রতিষ্ঠানে কর্মরত, যারা জীবন-জীবিকা চালাচ্ছেন এসব প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। কিন্তু আরএকে সিরামিক্সের সঙ্গে তিনি কিভাবে জড়ালেন? সে আরেক ইতিহাস। আরেক অধ্যায়।

১৯৯৪ সালে আরএকে সিরামিক্স দুবাইয়ে কারখানা চালু করে ব্যবসা শুরু করে। সৈয়দ একরামুজ্জামান যোগাযোগ করেন তাদের সঙ্গে। প্রথমে বাংলাদেশে দুবাই থেকে আরএকের টাইলস রপ্তানি শুরু করেন তিনি। আর দুবাইতেও বিক্রি শুরু করেন। টাইলস তখন বাংলাদেশে প্রায় নতুন। ৯৪ সালের শেষ দিক থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ হয় আরএকের সবচেয়ে বড় ইমপোর্টার। তখন প্রতি মাসে ২০ থেকে ২৫ কনটেইনার টাইলস আসত বাংলাদেশে। আর একরামুজ্জামান ব্যবসায় কৌশল নেন। যে কৌশলে বাংলাদেশের মার্কেট দখল করে নেয় আরএকে। সে সময় দেশে টাইলসের দাম যা ছিল আরএকের টাইলস বাজারে ছাড়েন তার অর্ধেক দামে।

পাশাপাশি আরএকের টাইলস গুণগত দিক দিয়ে বিশ্বমানের হওয়ায় বাংলাদেশের মার্কেট খুব সহজেই দখল করে নেয়। কিন্তু তার পরও সৈয়দ একরামুজ্জামানের মনে কষ্ট কাজ করত। ভাবত দেশের এত টাকা বাইরে চলে যাচ্ছে। এ থেকে কিভাবে বেরিয়ে আসা যায়? তিনি এ নিয়ে ভাবতে থাকলেন। সে সময় তার নিজের কারখানা করারও মেধা এবং সাহস ছিল না। এসব ভাবতে ভাবতে একদিন আরএকে সিরামিকের সিইও ড. খাতের মাসাদের সঙ্গে বাংলাদেশে প্লান্ট স্থাপনের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করেন একরামুজ্জামান।

ড. খাতের মাসাদ তাকে ক্রাউন প্রিন্স রাস আল খাইমা’র সঙ্গে আলোচনা করতে বলেন। সুখের ব্যাপার হচ্ছে, এক মিটিংয়ে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত পাকা হয়। এরপর মাত্র ১১ মাস সময়ের মধ্যে ঢাকার অদূরে গাজীপুরে রাস আল খাইমা (আরএকে) সিরামিকের বর্তমান ইন্ডাস্ট্রি প্রতিষ্ঠা হয়। ২০০১ সালে পূর্ণমাত্রায় এর উৎপাদন শুরু হয়।

উন্নত মান, চমৎকার ডিজাইন, বিপুলসংখ্যক ভ্যারাইটিজ ও প্রতিযোগিতামূলক দাম হওয়ার কারণে অল্প সময়ের ব্যবধানে আরএকে হয়ে ওঠে লিডিং কোম্পানি এবং এ সেক্টরের সর্বাধিক বিক্রীত পণ্য। আনপলিশ, পলিশ, ওয়াল এবং ফ্লোর টাইলস-এর জন্য আরএকের রয়েছে এক হাজারেরও বেশি ডিজাইন।

শুধু টাইলস নয়- আন্তর্জাতিক মানের স্যানিটারি অয়্যার, ইউরিন্যাল বেসিন, প্যান এবং বিভিন্ন এক্সেসরিজও উৎপাদন করছেন তারা। এ কারখানায় কাজ করছেন যথাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ নির্বাহীরা। আরএকে এ দেশে প্রতিষ্ঠার ফলে প্রচুর কর্মসংস্থান হয়েছে। আমদানি বিকল্প শিল্প প্রতিষ্ঠার ফলে একদিকে যেমন বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হচ্ছে, অন্যদিকে রফতানির মধ্য দিয়ে অর্জিত হচ্ছে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা।

গাজীপুরের শ্রীপুরে ২০০ বিঘা জমির ওপর তৈরি আরএকে সিরামিক্স কারখানায় উৎপাদন প্রথম শুরু হয় একটা লাইনে। এখন তিনটা লাইনে উৎপাদন হচ্ছে। আর এর উৎপাদন ক্যাপাসিটি প্রতিদিন আড়াইলাখ স্কয়ার ফিট। স্যানিটারিওয়্যার তৈরি হচ্ছে দৈনিক ৫০০০ পিস। বাংলাদেশে কারখানা হওয়ায় আরএকে শিল্পের যেমন উন্নতি হয়েছে, তেমনি হয়েছে সহজলভ্য। এ ছাড়া এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। এভাবে আস্তে আস্তে ব্যবসার প্রসার ঘটাতে থাকেন সৈয়দ একরামুজ্জামান।

তৈরি করেন আরএকে ফার্মাসিউটিক্যালস, যা একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। যেখানে ৪৮ প্রকার ওষুধ তৈরি হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে টেবলেট, ক্যাপসুল ও ইনজেকশন। যার বেশির ভাগই বিদেশে রপ্তানি করছেন। ওষুধের মধ্যে রয়েছে এন্টি ব্যাকটিরিয়াল, এনালগেসিক এবং এন্টি ইনফ্লামম্যাটরি, এন্টিডিপরেস্যান্ট, এন্টিকনভিউলসান্ট, এন্টি আলসেরান্ট, এন্টি স্পাসমোডিক, এন্টি হিস্টামিন, লিপিড লোওয়েরিং, এন্টি প্লাটিলেট, এন্টি হাইপারটেনসিভ, এন্টি ডায়াবেটিক, এন্টি এস্থামেটিক, এন্টি ইমেটিক, এন্টিপ্রোটোজল এবং ডারমাটোলোজিকেল জাতীয় ওষুধ।

ইতিমধ্যে হবিগঞ্জ এলাকাকে বদলে দিয়েছেন তিনি। সেখানে একে একে গড়ে তুলেন আরএকে পেইন্টস কারখানা। এ প্রতিষ্ঠানটিও এখন সাকসেসফুল কারখানা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। বাজারে থাকা বার্জার পেইন্টস ও এশিয়ান পেইন্টসের সঙ্গে আরএকেও এখন প্রতিযোগী। আরএকে পেইন্টস কারখানায় ৪৬ প্রকারের রঙের পেইন্ট উৎপাদন হচ্ছে। রংগুলোর মধ্যে রয়েছে ডার্ক খাকি, ব্রিলিয়ান্ট হুয়াইট, অপ হুয়াইট, ক্রিম কালার, আপেল হুয়াইট, লেমন ইয়েলো, গোল্ডেন ইয়েলো, পেইল রোস, লাইট পিংক, ডিপ ওরেঞ্জ, সিঙ্গেল রেড, পোস্ট অফিস রেড, রেড অক্সাইড, দুবাই চকোলেট, ব্ল্যাক, মিড গ্রিন, টোবাকো ব্রাউন ইত্যাদি। আরও রয়েছে মশার কয়েল তৈরির কারখানা।

ইতিমধ্যে যা মানুষের মধ্যে চাহিদা তৈরি করেছে। রয়েছে আরএকে পাওয়ার প্লান্ট, যা থেকে জাতীয় গ্রিডেও বিদ্যুৎ যুক্ত হচ্ছে। আরএকে রাকিন ডেভেলপমেন্ট প্রতিষ্ঠানটিও ইতিমধ্যে সুনাম কুড়িয়েছে। এটি একটি ডায়নামিক রিয়েল স্টেট কোম্পানি। ইতিমধ্যে মিরপুরে ২১০০ ফ্ল্যাটের কাজ চলছে। ২০১৬-১৭ সালের ভেতরে এর কাজ সম্পন্ন হবে। ৫০ বিঘা জমির ওপর হচ্ছে রাকিন স্যাটেলাইট টাওন।

এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুরে নেয়া হয়েছে আরও একটি প্রজেক্ট। যেখানে ৫০০০ ফ্ল্যাটের মডেল টাউন হবে। যেখানে থাকবে অত্যাধুনিক স্কুল, কলেজ, শপিং মল, হাসপাতালসহ নানা সুবিধা। হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জে স্টার সিরামিক্স নামে নতুন আরেকটি কারখানা করা হয়েছে। যেখানে প্রতিদিন উৎপাদন হচ্ছে আড়াই লাখ স্কয়ার ফিট টাইলস। ইতিমধ্যে যার চাহিদা ব্যাপক হারে বেড়েছে। এ ছাড়া সেখানে আগামী ২২শে সেপ্টেম্বর চালু হবে স্যানিটারিওয়্যার কারখানা।

উল্লেখযোগ্য দিক হলো দেশের ৩০ ভাগ স্যানিটারিওয়্যার বাজার আরএকে সিরামিক্সের দখলে। এ ছাড়া স্টার পরসোলিন নামে একটি কারখানার কাজ চলছে। যেখানে তৈরি হবে শুধু হোটেলে ইউজ করা পণ্য। যার শতভাগ রপ্তানি করা হবে। এ কোম্পানিটিও জয়েন্ট ভেঞ্চারে প্রতিষ্ঠিত। এর পার্টনার রয়েছে ফ্রান্স এবং সুইস কোম্পানি। সুবিধাজনক দিক হলো এ কোম্পানিগুলোই এসব মালামাল কিনে নিয়ে যায়।

ইউরোপের সব ফাইভ স্টার, ফোর স্টারসহ আধুনিক হোটেলে ব্যবহার হবে আরএকের তৈরি পণ্য। এ ছাড়াও সৈয়দ একরামুজ্জামান দৈনিক অর্থনীতি প্রতিদিন ও বাংলাভিশনের একজন পরিচালক। এ ছাড়া বেসরকারিভাবে প্রতিষ্ঠা করেন আরএকে সিকিউরিটি অ্যান্ড সার্ভিস লিমিটেড নামে একটি কোম্পানি। যেখানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মী দিয়ে দেশের বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, বীমা, বাসাবাড়ি সিকিউরিটির ব্যবস্থা করছে তার এ কোম্পানি। এসবের মধ্যে রয়েছে গার্ড সার্ভিস, বডি সার্ভিস (ভিআইপি, সিআইপি ও ব্যক্তিগত সিকিউরিটি), হাইরাজ বিল্ডিং সিকিউরিটি, ক্যাশ ক্যারিং। এ ছাড়া রয়েছে ম্যানপাওয়ার সার্ভিস, স্পেসালাইজড সার্ভিস ও মেইনটেনেন্স সার্ভিস।

নিত্যনতুন চিন্তা করেন একরামুজ্জামান। তারই প্রতিফলন দেখা যায় তার কাজে। সম্প্রতি তিনি পাইলিং কোম্পানি করেছেন। যাতে রয়েছে মডার্ন পাইলিং সিস্টেম। যে সিস্টেমে ৬ মাসের কাজ করতে লাগবে মাত্র দু’দিন। রয়েছে পল্লী প্রপার্টি ও কনস্ট্রাকশন কোম্পানি। এ কোম্পানির মাধ্যমে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশে গাজীপুরে নতুন প্রজেক্ট হাতে নেয়া হয়েছে। যেখানে থাকবে ৯০০ ফ্ল্যাট, শপিং মল ও ফোর স্টার হোটেল। হবিগঞ্জে রয়েছে প্যাকেজিং কারখানাও।

এভাবেই একরামুজ্জামান হবিগঞ্জে গড়ে তুলেছেন ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক। আর এসব প্রতিষ্ঠানের প্রধান অফিস হলো উত্তরায়। আরএকে টাওয়ার। যেখানে বসে তিনি সব ব্যবসার খবরাখবর নিচ্ছেন। কর্মীদের খবর নিচ্ছেন। প্রতিদিন সকাল ১১টায় অফিসে আসেন। একেবারে সন্ধ্যা পর্যন্ত অফিস করেন। এ সময়ের মধ্যেই বিভিন্ন লোকদের সময় দেন। ব্যবসায় এত সফলতার পেছনে মূলমন্ত্র কি? আরএকে সিরামিক্সের এমডি সৈয়দ একে একরামুজ্জামান বলেন, সততা, বিশ্বাস আর আমার কর্মীবাহিনীর ওপর আস্থা। বলেন, ব্যবসা করতে হলে মেইন সোর্স হলো ব্যাংক।

ব্যাংক যদি লোন না দেয় তাহলে ব্যবসা দাঁড় করানো সম্ভব নয়। অর্থাৎ ব্যাংক আপনাকে বিশ্বাস করতে হবে। ব্যবসা চলে রিপোটেশনের ওপর। আর বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে হয়। এর জন্য ব্যবসায়ীদের সততা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। তিনি বলেন, জার্মানি থেকে আমেরিকা চলে যেতে পারতাম। কিন্তু তা করিনি। এখন বুঝতে পারছি তা না করে ভালই করেছি। বাংলাদেশের সামনে অপার সম্ভাবনা। যিনি তা ধরতে পারছেন না তার জন্যই সমস্যা।

এ দেশের সবচেয়ে বড় সুবিধাজনক দিক হলো এখানে স্কিল, আনস্কিল, একেবারে ওপর থেকে দিনমজুর পর্যন্ত পাওয়া যায়। অর্থাৎ অল লেভেল অব পিপলস এভেলেবল। তবে বাংলাদেশে ইনভেস্টমেন্টের খারাপ দিক হচ্ছে সিকিউরিটি। মানুষ নিজেদের ইনসিকিউরড ফিল করে। এ বিষয়টি ওভারকাম করতে পারলে এ দেশে বিনিয়োগের অভাব হবে না।

ব্যবসার বাইরে পরিবারে কেমন আছেন একরামুজ্জামান? তিনি নিজেই বলেন, আমি খুব সুখী পরিবার। পুত্র সৈয়দ কামরুজ্জামান ইউকেতে মাস্টার্স করছে। আগামী বছর মাস্টার্স কমপ্লিট করে ব্যবসায় মনোযোগ দেবে। মেয়ে সাঈদা শায়লিন জামান বিবাহিত। মেয়ের জামাই ফজলে হাসান আকবর একজন ব্যাংকার। একরামুজ্জামান বলেন, স্ত্রী নাঈমা জামান আমার জীবনের চলার পথের সাহসী এক যোদ্ধা। যিনি আমাকে সব সময় সাহস যুগিয়েছেন।

তিনি বলেন, আমি এগোনোর পেছনে জার্মান জীবনটা আমাকে হেল্প করেছে। আমি জার্মানিতে নিম্ন পর্যায়ে কাজ করে এসেছি। আর এ কারণেই সব মানুষকে আমি মূল্যায়ন করি। আমার কাছে সবাই মানুষ। আর আমাকে ছেড়েও কোন স্টাফ যায় না। যারা দিনের পর দিন আমার সঙ্গে কাজ করছেন। এমনও স্টাফ আছেন যারা ২০০০ টাকা বেতন থেকে শুরু করে এখন ২ লাখ টাকা বেতন পাচ্ছেন। অর্থাৎ মানুষকে সম্মান করা আমার ধর্ম। আজীবন তা করে যাবো।

মানবসেবা তার নেশা। নীরবে-নিভৃতে সাহায্য-সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেন। দেশ-বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে দিচ্ছেন অনেক মানুষের। একরামুজ্জামানের ইচ্ছা তার নিজ এলাকায় একটি আধুনিক হাসপাতাল করার। যেখানে ঢাকা থেকে মানুষ যাবে সেবা নিতে। আর দেশের বড় বড় সব ডাক্তারকে সেখানে আনা-নেয়ার জন্য থাকবে নিজস্ব হেলিকপ্টার। এ ছাড়া নাসিরনগরে একটি বিশ্ববিদ্যালয় করারও ইচ্ছা তার।

একরামুজ্জামানের নিজ গ্রাম চাপড়তলায় কোন স্কুল ছিল না। সেখানে তার পিতার নামে উচ্চবিদ্যালয় করা হয়েছে। এ ছাড়া দানশীল একরামুজ্জামান নানাভাবে গরিব-অসায়দের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। শুধু নিজ এলাকা নয়, দেশের যে কোন প্রান্ত থেকে অসহায় লোকজন এলে তিনি তার উদার হস্ত বাড়িয়ে দেন। এ ছাড়া এলাকায় মেডিকেল ক্যাম্প করে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন।

রাজধানী ঢাকা থেকে ডাক্তার নিয়ে তাদের ট্রিটমেন্ট ও ওষুধ ফ্রি দিচ্ছেন। তার কাছে এসে খালি হাতে কেউ ফিরে গেছেন এমন নজির নেই। তিনি বলেন, আমার একটা চ্যারিটি ফান্ড রয়েছে। যে ফান্ড কাজ করে শুধু মানুষের জন্য। এনজয় করি জনসেবাকে। মানুষের জন্য কল্যাণকর সমস্ত কাজকেই এনজয় করি।

একরামুজ্জামান বলেন, সারা জীবনই স্ট্রাগল করেছি। এখনও করছি। একটা সফলতা দিয়ে আরেকটা সফলতাকে বিট করার মধ্যেই আমার আনন্দ। আমি স্থির বসে থাকার মধ্যে সন্তুষ্টি পাই না। শুধু নিজের প্রতিষ্ঠান-ব্যবসার উন্নয়ন ঘটানোর মধ্যেই নিজের চিন্তা-ভাবনাকে সীমাবদ্ধ করে রাখেননি একরামুজ্জামান। চিন্তা করেন দেশ-জাতির উন্নতি নিয়ে। তার মতে, মাত্রাতিরিক্ত জনসংখ্যা, ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ না থাকা এবং মানসম্মত শিক্ষার অভাব আমাদের পিছিয়ে দিচ্ছে।

দেশের উন্নয়নের বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে এসব সমস্যা। সন্ত্রাস-দুর্নীতির বিস্তারও ঘটছে এসব কারণে। আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। এ লক্ষ্যে সরকারকে শ্রমবহুল ব্যবসার ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। আমরা যারা আছি, আমাদের প্রত্যেককেই ঘুম থেকে ওঠে চিন্তা করতে হবে আমি আজকে কয়টা অ্যাপয়েনমেন্ট জেনারেট করতে পেরেছি।

একরামুজ্জামান বলেন, আমার অভিজ্ঞতা বলে বাংলাদেশ বিনিয়োগের জন্য খুবই ভাল জায়গা। আপনার যদি টাকা থাকে তাহলে সরকারের সহযোগিতার দরকার হবে না। সরকার আপনাকে অসহযোগিতা না করফকারখানা স্থাপনের মাধ্যমে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ নিয়ে আসা, বৈদেশিক মুদ্রা আয়, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি ছাড়াও একরামুজ্জামান স্বপ্ন দেখেন এলাকার মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের। আর তাই নিজেকে সম্পৃক্ত করেন রাজনীতিতে।

পরিচ্ছন্ন ইমেজের কারণে সহজেই এলাকার মানুষের মধ্যে স্বীয় অবস্থান করে নেন। নিজের উপজেলা নাসিরনগরকে মডেল উপজেলা করার স্বপ্ন লালন করেন তিনি। বলেন, সুযোগ পেলে আমি অবশ্যই এ কাজটি করব। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে যাতে লোকজন নাসিরনগরকে দেখতে আসেন। এলাকার প্রতি টান থেকেই প্রতি সপ্তাহেই ছুটে যান এলাকায়। ঘুরে বেড়ান নাসিরনগরের প্রতিটি গ্রাম। মানুষের সুখ-দুঃখে পাশে দাঁড়ান। মানুষের অভাব-অভিযোগ শুনে সঙ্গে সঙ্গে তার সমাধান দেন। একজন ব্যবসায়ী, একজন সমাজসেবী এবং একজন সফল মানুষ হিসেবে একরামুজ্জামান এক ইতিহাস।

তথ্যসূত্র: ইন্টারনেট।

Facebook Comments
error: Content is protected !!