ইংরেজিতে একটা কথা আছে, “A picture is worth more than a thousand words”,- দৃষ্টিলব্ধ কোনো কিছুর মর্মার্থ বুঝাতে এমনটি বলা হয়।
কখনো কি ভেবে দেখেছেন যে লোগো দেখেই কেনো প্রতিষ্ঠানের প্রকৃতি বলে দেওয়া যায়? এমনকি প্রথমবার দেখেই প্রতিষ্ঠানের সেবার মান ও মনন উপলব্ধি করা যায়? লোগোই যেনো হাজার কথা বলে! একটি লোগোই যেনো কোটি টাকার ঐশ্বর্য!
লোগো খুব সংক্ষিপ্ত তবে খুব অর্থবহ একটি যোগাযোগের মাধ্যম। লোগোর উপর নির্ভর করে একটা প্রতিষ্ঠানের ইমপ্রেশন। কোনো বিজনেসের ব্র্যান্ডিং খরচের অন্যতম এক ক্ষেত্র হলো লোগো তৈরি করা। একারণেই কফি শপ থেকে কেএফসি, জনপরিবহন থেকে কার কোম্পানি, ডিজাইন এজেন্সি থেকে সফটওয়্যার কোম্পানি, পোশাকের ব্র্যান্ড, ম্যাগাজিন সহ সব প্রতিষ্ঠানেই আছে লোগোর ব্যবহার।
এই অর্টিকেলে লোগো তৈরি, লোগোর গুরুত্ব, উপকারিতা, প্রকারভেদ, লোগো তৈরির জন্য করণীয় বিষয় ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করা হবে।
লোগো হলো যেকোনো ধরনের প্রতিক, যা একটি প্রতিষ্ঠান, কোম্পানি, পণ্য বা ব্র্যান্ডকে ভিজুয়্যালি উপস্থাপন করে বা দৃষ্টিগোচর করে। লোগো মূলত একটি প্রতিষ্ঠানকে উপস্থাপন করে এবং স্বনির্ভরতার পরিচিতি দেয়। যেমন: মিশরে ১৩শ শতকে একটি মাত্র হায়ারোগ্লিফিক চিহৃ ব্যবহার করা হয় প্রতিষ্ঠানের স্বত্ব বুঝাতে। আর এভাবেই আধুনিক লোগোর যাত্রা শুরু হয়।
লোগোতে একটি মাত্র চিহৃ বা বিমূর্ত কোনো কিছু রূপায়ন হতে পারে, আবার প্রতিষ্ঠানের নামকেই ডিজাইন করার মাধ্যমে লোগো তৈরি করা যেতে পারে। তবে ডিজাইন যেটাই হোক, লোগো মূলত একটি প্রতিষ্ঠানের ধরণ, সেবার ধরণ, মনন ও রুচি ফুটিয়ে তোলে। লোগে দেখেই প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে জনসাধারণের উপলব্ধি গড়ে উঠে।
লোগো একটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিত্ব করে বা চেহারার মতো কাজ করে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে লোগোই প্রথম জিনিস যা একজন গ্রাহক দেখে থাকেন। পরবর্তীতে সেই প্রতিষ্ঠানের কথা মাথায় আসলে, শুরুতেই তার লোগো চোখে ভেসে উঠে। কিছু না বলেও যেনো সব কিছু বলে দেয় একটি লোগো। এছাড়াও আরো কিছু কারনে একটি প্রতিষ্ঠানের জন্য লোগো অত্যাবশ্যক:
১। প্রতিষ্ঠানের ব্র্যান্ডিং এর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যার উপর বাকি সবকিছু নির্ভর করে। ব্র্যান্ড আইডেনটিটির সূচনা করে একটি লোগো।
২। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠানের থেকে একটি প্রতিষ্ঠানকে আলাদাভাবে উপস্থাপন করে একটি লোগো।
৩। লোগো গ্রাহক এবং একটা কোম্পানির পরিচিতির কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে। আর্কষণীয় কালার, সেইপ দিয়ে ডিজাইন করা একটি সুপরিকল্পিত লোগো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমাদের মস্তিষ্কে জায়গা করে নেয়, যা কাস্টমারকে ওই প্রতিষ্ঠানের প্রতি বারবার আগ্রহী করতে পারে।
৪। একটি আকর্ষণীয় ও অর্থবহ লোগো, মুহূর্তেই সম্ভাব্য গ্রাহককে আর্কষণ করতে পারে।
৫। লোগো আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহনকে প্রভাবিত করে। অনেকসময় আমরা কেবল লোগো দেখে, কয়েক সেকেন্ডেই একটা ইমপ্রেশনস গঠন করে ফেলি প্রতিষ্ঠানের মান, মনন ও সেবা সম্পর্কে।
৬। প্রতিষ্ঠানের মননের পরিচয় ও অতিরিক্ত তথ্য দিতে পারে একটি লোগো। বিষয়টা খেয়াল করা যায় আমাজনের লোগোতে। এর কম্বিনপশন মার্ক লোগোর নিচের স্মাইলিং ফেস ‘কাঙ্খিত কিছু পাওয়ার খুশি’, একসাথে অ্যারো হিসেবে A to Z বুঝায়।
৭। যেকোনো মিডিয়াডে কাজে লাগে একটি লোগো। যেমন: মার্কেটিং, পণ্য, প্যাকেজিং, সোশ্যাল মিডিয়া, ওয়েবসাইট ইত্যাদি।
লোগো নিয়ে কিছু তথ্য:
১৩ শতকে মিশর প্রথম হায়ারোগ্লিফিক চিহ্ন ব্যবহার করা হয় মালিকানার প্রমাণ স্বরূপ। তবে মর্ডান লোগোর যাত্রা শুরু হয় ১৪৪০ সালে এবং কমার্শিয়াল লোগোর ব্যবহার শুরু ১৯১০-১৩ সালে। আর, ১৯৭০ সালের মধ্যে সকল প্রতিষ্ঠান বুঝতে পারে যে একটি প্রতিষ্ঠানের ভিজুয়াল পরিচিতি আবশ্যক।
বর্তমানে ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো লোগোর পিছনে মোটা অংকের টাকা ব্যয় করে:
লোগোর বৈশ্বিক পরিসংখ্যান ও অন্যান্য তথ্য:
প্রতিষ্ঠান যেমনই হোক না কেনো, তার লোগো তৈরির পূর্বে কিছু বিষয় অবশ্যই জানতে হবে।
1. প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য, উদ্দ্যেশ্য ফুটিয়ে তোলাই হবে লোগোর মূল ভূমিকা। একটি আদর্শ লোগো সার্বিকভাবে খুব সাধারণ, মনে রাখার যোগ্য, নির্ভর যোগ্য, অর্থবহ এবং নিরন্তর হবে।
2. লোগোতে প্রতিষ্ঠানের কাজের ধরণ, অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানের সেবা বা পন্য কী বা কেমন তা ফুটিয়ে তুলতে হবে, যেনো লোগো দেখেই জনসাধারণ বুঝতে পারে এটা কী ধরনের প্রতিষ্ঠান, তাদের সেবা বা পণ্য কী হতে পারে।
3. প্রতিদ্বন্দ্বীদের নিয়ে গবেষণা করা প্রাথমিক পদক্ষেপ। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠান কোন ধরনের, কেমন কালারের লোগো ব্যবহার করে, কীভাবে আমার লোগো স্বকীয় হবে, বেশি ফুটে উঠবে-এসব নির্ধারণ করার একমাত্র উপায় প্রচুর গবেষণা করা। আর স্বকীয় লোগোই হবে প্রতিষ্ঠানের ব্র্যান্ডিং শুভ সূচনা।
4. একটি যথাযোগ্য লোগে এমন হবে যা প্রথম ইমপ্রেশনকে করবে পজেটিভ। তার প্রতিষ্ঠানের পরিচিতি ঠিক মতো ফুটিয়ে তুলতে পারছে কিনা সেটা বিবেচনা করাই হবে মূল লক্ষ্য। লোগোর লুকানো অর্থ থাকতেই হবে, এমন নয়। সময়ের সাথে, মিথষ্ক্রিয়ার ফলে, লোগো নিজের থেকেই অর্থবহ হবে।
5. “There is nothing more expensive than a cheap design” কম টাকায়, সস্তা লোগো তৈরি করলে প্রথম ইমপ্রেশনকে জয় না করতে পারলে, সেটাই হবে প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রথম খারাপ পদক্ষেপ। তাই লোগোর এক্ষেত্রে খুব সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। সাদা-কালোতে ডিজাইন করে দেখতে হবে। একটা আদর্শ লোগো কালারফুল না হয়েও সমান গ্রাভিটি বহন করবে। তাই সাদা কালোতে ডিজাইন করে দেখতে হবে। আবার অনেক প্লাটফর্মে কেবল সাদ কালোতেই পাবলিশ করতে হয়। একটি লোগো সব মিডিয়াতে ব্যবহারের উপযোগী হতে হবে।
অনেক সময় লোগো দেখেই প্রতিষ্ঠান চেনা যায়, কারণ প্রতিষ্ঠানের নামই লোগো। আবার অনেক ক্ষেত্রে কোনো বর্ণ ছাড়াই প্রতিষ্ঠানকে চেনা যায়। আবার কখনো এই দুইয়ের মিশ্রণে গঠিত হয় আরেক ধরণের লোগো। প্রতিষ্ঠান প্রকৃতি বুঝে লোগো নির্বাচন করতে হবে।
লোগো প্রধানত ৩ ভাগে বিভক্ত। এই প্রকারকে আবার ৭ ভাগে বা ৭টি সাব-ক্যাটেগরিতে ভাগ করা হয়।
১. টাইপোগ্রাফিক লোগো
২. আইকনিক লোগো
৩. কম্বাইন্ড লোগো (টাইপোগ্রাফিক + আইকনিক)
✪ টাইপোগ্রাফিক লোগো:
ছবি ছাড়া একটি লোগো কতোটা আকর্ষণীয় হতে পারে তার প্রমাণ হলো টাইপোগ্রাফিক লোগো। শেপ, কালার ও ফন্টের সঠিক ব্যবহারে টেক্সট নিজেই ছবি হয়ে উঠতে পারে। টাইপোগ্রাফিক লোগোকে ২ ভাগে ভাগ করা যায়:
১. মনোগ্রাম বা লেটারমার্ক: যেসব কোম্পানির নাম বড়, তারা নামের সংক্ষিপ্ত রূপ বা নির্দিষ্ট কিছু বর্ণ দিয়ে মনোগ্রাম লোগো তৈরি করে। নাসা, বিবিসি, সিএনএন, এইচপি ও এইচবিও সহ আরো অনেক বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানের লোগো মনোগ্রাম।
২. ওয়ার্ডমার্ক: প্রতিষ্ঠান নামের সংক্ষিপ্ত রূপ ব্যবহার না করে যখন পুরো নামই টাইপোগ্রাফি করা হয়, তখন সেটা ওয়ার্ডমার্ক। এই ধরনের লোগোতেও শুধু বর্ণ থাকে।
গুগলের লোগো কে না চেনে? গুগল, কোকাকোলা, ই-বে ও ভিসা সহ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের লোগো হলো ওয়ার্ডমার্ক।
✪ আইকনিক লোগো:
অনেক সময় ছবিই কথা বলে। এ ধরনের লোগোতে কোনো বর্ণ বা শব্দ ব্যবহার করা হয় না।
আইকনিক লোগো ৩ প্রকার:
১. পিকটোরিয়াল লোগো: লোগো বলতে আমরা সাধারণ পিকটোরিয়ালকেই বুঝে থাকি। এই ধরনের লোগে কোনো আইকন, ছবি বা গ্রাফিক্স নির্ভর। অ্যাপল, টুইটার, সেলের লোগো হলো পিকটোরিয়াল।
২. অ্যাবস্ট্রাক্ট লোগো: বিভিন্ন জ্যামিতিক আকারের, বিমূর্ত কিছু থেকে গঠিত লোগোকে অ্যাবস্ট্রাক্ট লোগো বলে। এসব লোগে সাধারণত কোনো অর্থ বহন করে না। গুগল ড্রাইভ, পেপসি, নাইকি ইত্যাদির লোগো অ্যাবস্ট্রাক্ট।
৩. মাসকট লোগো: মানুষ, পশু বা কোনোকিছু চিত্রায়ন বা ইলুস্ট্রেশন করে এমন লোগো তৈরি করা হয়। যেমন: কেএফসি এর সবথেকে বড় উদাহরণ।
✪ কম্বাইন্ড লোগো:
কখনো কখনো টাইপোগ্রাফিক ও আইকনের মেলবন্ধনে বিশেষ ধরনের লোগো তৈরি করা হয়। এমন লোগো ২ প্রকার:
১. এমব্লেম: একটি সিম্বলের সাথে যখন বর্ণ, লেটার, ক্রেস্ট বা এমন ছবি জুড়ে দেওয়া হয়, তখন সেটা এমব্লেম লোগো। এমন ক্লাসিক্যাল লোগো স্কুল, কলেজে, সরকারি প্রতিষ্ঠানে দেখা যায়। যেমন: বিএমডাব্লিউ, হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়।
২. কম্বিনেশন মার্ক: এ ধরনের লোগোতে ওয়ার্ডমার্ক অথবা লেটারমার্কের সাথে যেকোনো ইমেজারি এবং আইকন লোগো মিলিয়ে তৈরি করা হয়। বাম, উপরে, ব্যাকগ্রাউন্ড ইত্যাাদি অবস্থানে টাইপোগ্রাফিক ব্যবহার করা হয়। এমন লোগো খুব বেশি আকর্ষণীয় হয়। যেমন: স্যামসং, অ্যামাজন, ডাভ ইত্যাদি।
পরিশেষে বলাই যায় যে, প্রতিষ্ঠানকে একটি স্বনির্ভর পরিচয় দিতে লোগোর গুরুত্ব অপরিসীম এবং অদ্বিতীয়। তাই একটি প্রতিষ্ঠানের প্রথম অর্থবহ পদক্ষেপ হওয়া উচিত একটি অর্থবহ এবং আদর্শ লোগো তৈরি করা। এতক্ষণের আলোচনায় এই বিষয়টিই ফুটিয়ে তোলার চেস্টা করা হয়েছে। আশা করি আর্টিকেলটি পড়ে ব্যবসার প্রচারে ফেসবুক মার্কেটিং এর গুরুত্ব বুঝতে পেরেছেন। সেইসাথে অনেক অনেক ধন্যবাদ কস্ট করে আর্টিকেলটি পড়ার জন্য, ভুলত্রুটি হলে অবশ্যই পজেটিভ ক্রিটিসিজম করতে ভুলবেন নাহ।