অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা কি উঠে যাবে?

লেখক:
প্রকাশ: ৭ years ago

আতঙ্কটা দিন দিন যেন ‘সিন্দাবাদের ডাইনি বুড়ি’ হয়ে উঠছে। নামছেই না ঘাড় থেকে। কত প্রতিবাদ, মিছিল, মিটিং, মানববন্ধন, লেখালেখি, আলোচনা সভা এ নিয়ে! নাহ, কিছুতেই কিছু হল না। যেন হওয়ারও নয়। উল্টো আতঙ্কটা ফুলেফেঁপে বেড়ে চলেছে।

হ্যাঁ, বলছি তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার কথা। গত ৬ বছর ধরে তর্ক-বিতর্ক। তারপরও এই গলার কাঁটা সরে না। জনদাবি ও গণমাধ্যম কর্মীদের আপত্তির মুখে দুই মন্ত্রী (তথ্য ও আইন মন্ত্রণালয়) একাধিকবার ধারাটি বাতিলের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

কিন্তু সেটা ওই প্রতিশ্রুতি পর্যন্ত। উল্টো ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ নামে সরকার ওই ধারার বিশদ ও ভয়াল সংস্করণ প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে। তাতে ‘নতুন বোতলে পুরনো মদ’ স্টাইলে ৫৭ ধারা তো থাকছেই, সঙ্গে যোগ হয়েছে গুপ্তচরবৃত্তিজনিত ৩২ ধারা নামে আরেক বিতর্কিত ও বহুগুণ ভয়ংকর ধারা।

২৯ জানুয়ারি যখন মন্ত্রিসভায় ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮’-এর খসড়া অনুমোদন দেয়া হয়, তখনই সমালোচনার ঝড় ওঠে। গণমাধ্যম কর্মী, মানবাধিকার কর্মী, বিদেশি কূটনীতিক, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনসহ দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সচেতন মহল বা সংগঠন সরকারের এই হঠকারী উদ্যোগের তীব্র নিন্দা ও আপত্তি জানায়।

সরকারের তরফ থেকে তখন প্রস্তাবিত আইনটির আপত্তিকর ধারাগুলো বাতিল বা সংশোধনের আশ্বাস দেয়া হয়। ৯ এপ্রিল যখন বিলটি সংসদে উত্থাপন করা হয়, তখন আবিষ্কার হল অবস্থা ‘যেই লাউ, সেই কদু’। সরকার যথারীতি এবারও কথা রাখেনি।

বিতর্কিত ধারাগুলো প্রায় বহাল তবিয়তে জায়গা করে নেয় নতুন কালো আইনের খসড়ায়। পরিস্থিতির ভয়াবহতা ও সরকারের একরোখা মনোভাব দেখে ১৯ এপ্রিল দেশের শীর্ষ ও বরেণ্য সম্পাদকরা ‘সম্পাদক পরিষদ’-এর ব্যানারে আইনমন্ত্রীসহ তিন মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৬টি ধারার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক আপত্তি ও উদ্বেগ জানায়।

তাদের অভিযোগ, ওই ৬টি ধারা ‘বাকস্বাধীনতা এবং সাংবাদিকদের স্বাধীনতার পরিপন্থি’। ওইদিন আইনমন্ত্রী নিজেও আপত্তিগুলোকে ‘অনেকাংশে যৌক্তিক’ আখ্যা দিলেন। সঙ্গে যথারীতি এবারও আপত্তিগুলো বিবেচনার আশ্বাস দেন।

পরবর্তীকালে ২২ এপ্রিল এ বিষয়ক সংসদের স্থায়ী কমিটিও সম্পাদক পরিষদের উদ্বেগকে বিবেচনার আশ্বাস দেয়। কথা হচ্ছে, এ আশ্বাসে ভরসা কতটুকু? এরকম আশ্বাস তো গত ছয় বছর ধরে দেয়া হচ্ছে। কিন্তু দিন শেষে ফল দাঁড়ায়, ‘বিচার মানি, কিন্তু তালগাছটা আমার’।

অবশ্য আইনমন্ত্রী বরাবরই বলে আসছেন, প্রস্তাবিত ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন সাইবার ক্রাইম রোধের জন্য। বাকস্বাধীনতা বা সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রোধের জন্য নয়। আসলে কী তাই?

সম্পাদক পরিষদের আপত্তিকৃত ৬টি ধারার (২১, ২৫, ২৮, ৩১, ৩২ ও ৪৩) মধ্যে আতঙ্কের সবচেয়ে বেশি উত্তাপ ছড়াচ্ছে ৩২ ধারা।

যার ভাষ্য হল- যদি কোনো ব্যক্তি বেআইনি প্রবেশের মাধ্যমে কোনো সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা বিধিবদ্ধ কোনো সংস্থার অতিগোপনীয় বা গোপনীয় তথ্য-উপাত্ত কম্পিউটার, ডিজিটাল যন্ত্র, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ধারণ, প্রেরণ বা সংরক্ষণ করেন বা করতে সহায়তা করেন, তাহলে সেই কাজ হবে কম্পিউটার বা ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ।

সাধারণভাবে, অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের প্রধান রসদ হল গোপন সূত্রে প্রাপ্ত গোপনীয় তথ্য-উপাত্ত। এখন প্রস্তাবিত আইনটি পাস হলে, সাংবাদিকদের কেউ আর সহজে তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সহায়তা করবে না।

এনালগ হোক, আর ডিজিটাল হোক; গোপনীয় বা অগোপনীয়, কোনো অফিসের কর্মকর্তা আর সহজে কাউকে কোনো কাগজপত্রের ছবি তুলতে দেবে না।

কারণ ১৪ বছরের জেল বা ২৫ লাখ টাকা (৩২ ধারার সাজা) জরিমানার ঝুঁকি কোন সোর্স নেবে? সাংবাদিকরা নিজেরাই হয়তো নিতে চাইবে না। তাতে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা বা সরকারের অনিয়ম-দুর্নীতির খবর একেবারে বন্ধ হয়ে গেলেও অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না। হয়তো সরকার এটাই চায়।

৩২ ধারার আতঙ্ককে ‘আইনমন্ত্রী’ যতই ‘অহেতুক ভীতি’ হিসেবে ব্যাখ্যা দিন, ৩২ ধারার ভাষ্য যতই ‘হ্যাকিং নিউজ’ বা ‘উইকিলিকীয় সাংবাদিকতা’ প্রতিরোধক মনে হোক, বাস্তব চিত্রটা হবে ভিন্ন।

যে দেশে ছাগল মরার সংবাদ শেয়ারে প্রতিমন্ত্রীর মানহানি হয়, তজ্জন্য ১৪ বছর কারাদণ্ডযোগ্য মামলা হয়, সাংবাদিক গ্রেফতার হয়; সে দেশে ৩২ ধারা তো গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধে রীতিমতো তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহৃত হবে- এ আর এমন অস্বাভাবিক কী?

‘অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা’ বিশ্বজুড়ে প্রতিষ্ঠিত ও সাংবাদিকতার খুব জনপ্রিয় একটা মাধ্যম। দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠন ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় এই সাংবাদিকতার কার্যকারিতা এতটা প্রমাণিত যে, বিভিন্ন দেশে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকে কেবল সমর্থনই নয়, অনেক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া হয়। অনুসন্ধানী প্রতিবেদন (জনপ্রিয় নাম ‘Whistleblower’) ও সংবাদের সোর্সকে দেয়া হয় বিশেষ রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা। তজ্জন্য অনেক দেশে ‘Whistleblower Protection Act’ পর্র্যন্ত প্রণয়ন করা হয়েছে। যেমন : ভারতে আছে The Whistle Blowers Protection Act, 2011; ইংল্যান্ডে the Public Interest Disclosure Act (PIDA) 1998; আমেরিকায় The Lloyd-La Follette Act of 1912, The Espionage Act of 1917, The Dodd~Frank Wall Street Reform and Consumer Protection Act (Section 922) ইত্যাদি; জ্যামাইকায় The Public Interest Disclosure Act 1998, কানাডায় Public Servants Disclosure Protection Act (The Act), 2007; আয়ারল্যান্ডে The Whistleblower Protection Law, 2012।

নেদারল্যান্ডস, সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ঘানা, দক্ষিণ আফ্রিকা, দক্ষিণ কোরিয়াসহ আরও অনেক দেশে এরূপ আইন আছে (তথ্যসূত্র: উইকিপিড়িয়া)।

আর আমাদের দেশে এরকম সমর্থন-সুরক্ষা দূরে থাক, উল্টো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারার মাধ্যমে সরকার যেন অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার কবর রচনার উদ্যোগ নিয়েছে। অথচ এখানে বাকস্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা- দুটিই সংবিধানস্বীকৃত অধিকার।

অবশ্য এটা ঠিক, দেশটা দিন দিন ডিজিটাল হয়ে উঠছে। দিন দিন বাড়ছে প্রযুক্তির উৎকর্ষ। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সাইবার ক্রাইম। নিত্যনতুন সাইবার ক্রাইমের যে আগ্রাসন ও ভয়াল থাবা, তা দমনের জন্য যে আইনি কাঠামো প্রয়োজন, তা আমাদের নেই।

ওই বিবেচনায় প্রস্তাবিত আইনটি নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ ও সময়ানুগ সংযোজন। আমাদের ডিজিটাল জীবনকে নিরাপদ করার জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের উদ্যোগ বা ভাবনা অবশ্যই প্রশংসনীয়।

কিন্তু সরকারের একটা অংশ এই শুভ উদ্যোগে অশুভের কালিমা লেপন করেছে। আলোর ফোয়ারায় পুরে দিয়েছে, আঁধারের বীজ। যার নমুনা ৩২ ধারাসহ আলোচ্য বিতর্কিত ধারাগুলোর সংযোজন।

বিশেষ ক্ষমতা আইন, ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারা, দ্রুত বিচার আইন- এসব আইনের কোনোটার উদ্দেশ্যই শুরুতে খারাপ ছিল না। প্রতিটি আইনের আত্মপ্রকাশ ছিল মহৎ আইন হিসেবে।

কিন্তু সময়ের আবর্তনে জননিরাপত্তায় প্রণীত এসব আইনই পরিণত হয় জননিরাপত্তাহীনতার মোক্ষম উপাদান। মানুষের নিশ্চিন্ত ঘুমের জন্য, যে আইনের জন্ম, পরবর্তীকালে সেই আইনই রূপ পায় ঘুম হারাম বটিকায়।

আমরা চাই না, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটিও কালো আইনের শিরোপা পাক। চাই না, আইনটি নিরপরাধ মানুষের আতঙ্ক বা বিভীষিকা হয়ে উঠুক। এক ৫৭ ধারার কেরামতি গত ৬ বছর মানুষ দেখেছে।

আশা করি, সরকার প্রস্তাবিত আইনের বিতর্কিত ধারাগুলো বাদ বা সংশোধন করে জাতিকে একটি মহৎ আইন উপহার দেবে। একই সঙ্গে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের হাত থেকে নিরীহ জনগণকে নিরাপদ রাখবে।

আফতাব উদ্দিন ছিদ্দিকী রাগিব : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট

aftabragib2@gmail.com

Facebook Comments
error: Content is protected !!