বিভীষিকাময় সেই রাত ও প্রতিরোধের সূচনা

লেখক:
প্রকাশ: ৭ years ago

১৯৬৮ সালে ভিয়েতনামের মাইলাই গ্রামে মার্কিনিদের চালানো নারকীয় গণহত্যা বিশ্ববিবেককে স্তম্ভিত করে দিয়েছিল। কিন্তু ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে ঢাকাসহ তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানে চালানো গণহত্যা ছিল তার চেয়েও নৃশংস। ২৫ মার্চ শহর থেকে গ্রাম- গোটা বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিভীষিকা ছড়িয়ে পড়ে। রক্তের সাগরে দাঁড়িয়ে রুখে দাঁড়ায় বাংলার আপামর মানুষ। শুরু হয় স্বাধীনতার জন্য লড়াই।

অপারেশন সার্চলাইটের পরিকল্পনা: ১৯৭১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর এক বৈঠকে আনা প্রস্তাবনা ও সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে মার্চের শুরুতে পাকিস্তানের ১৪তম ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল খাদিম হুসাইন রাজা ও মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী পূর্ব পাকিস্তানে অপারেশনের মূল পরিকল্পনা তৈরি করেন। বৈঠকে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানের কোয়েটা থেকে ১৬তম ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশন ও খরিয়ান থেকে ১৯তম ডিভিশনকে পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়।

পূর্ব পাকিস্তানের জিওসি লে. জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খান ও পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ভাইস অ্যাডমিরাল এসএম আহসান পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ জনগণের ওপর সামরিক হামলা চালানোর বিরোধী ছিলেন বলে অপারেশনের আগেই তাদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

এরপর লে. জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ও জিওসি করে পাঠানো হয়। ১৭ মার্চ পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সিওএস জেনারেল হামিদ টেলিফোন করে জেনারেল রাজাকে অপারেশনের পরিকল্পনা করার দায়িত্ব দেন। ১৮ মার্চ সকালে ঢাকা সেনানিবাসের জিওসি কার্যালয়ে বসে জেনারেল রাজা ও মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী অপারেশনের পরিকল্পনা তৈরি করেন। রাও ফরমান আলী নিজ হাতে একটি অফিস প্যাডে পরিকল্পনা লিখে ফেলেন। অপারেশনের সিদ্ধান্ত ও সেটি যথাযথভাবে বাস্তবায়নের শর্ত- ইত্যাদির সীমা তৈরি করেন তিনি।

জেনারেল খাদিম সেনাদলের স্থান বিতরণ, বিভিন্ন ব্রিগেড ও ইউনিটের ওপর সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব বণ্টন ইত্যাদি কাজ তদারকি করেন। বাঙালি সেনা সদস্যরা অপারেশনের শুরুর সময় বিদ্রোহ করতে পারে- এমন সন্দেহে তারা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলাপ করেন। এ সময় তারা বাঙালি সৈন্যদের অপারেশনের আগেই নীরস্ত্র করার ও পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেফতারের প্রস্তাব দেন। অপারেশনের পরিকল্পনা চূড়ান্ত হওয়ার পর ২০ মার্চ লিখিত সেই পরিকল্পনা পর্যালোচনা করেন জেনারেল হামিদ ও লে. জেনারেল টিক্কা খান।

জেনারেল হামিদ প্রথমে ইপিআর, আর্মড পুলিশ ও আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্যদের নীরস্ত্র করার অনুমতি দেন। আর ইয়াহিয়া খান তার সঙ্গে বৈঠকে আওয়ামী লীগ নেতাদের গ্রেফতারের পরিকল্পনা নাকচ করে দেন। পুণঃনির্ধারিত পরিকল্পনা অনুমোদন করার পর বিভিন্ন এলাকার কমান্ডারদের কাছে গোপনে পাঠানো হয়।

এদিকে ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমণ্ডিস্থ বাসভবনে এক সংবাদ সম্মেলন হয়। সেখান থেকে ঘোষণা করা হয়, সেনাবাহিনীর চালানো হত্যা ও নির্যাতনের প্রতিবাদে ২৭ মার্চ দেশব্যাপী হরতাল পালন করা হবে। শেখ মুজিবের পক্ষ থেকে হরতালের ঘোষণার পরপরই সন্ধ্যা সোয়া সাতটায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বিমানে ঢাকা ত্যাগ করেন।

অপারেশন সার্চলাইট শুরু: অপারেশন শুরুর পূর্ব নির্ধারিত সময় ছিল ২৫ মার্চ রাত ১টা। অন্যান্য গ্যারিসনকে ফোন করে জিরো আওয়ারে (অপারেশন শুরুর সময়) তাদের কার্যক্রম শুরু করার জন্য প্রস্তুত থাকতে বলা হয়। ঢাকার সৈন্যদের কমান্ডার ছিলেন রাও ফরমান আলী। অন্যসব স্থানের সৈন্যদের কমান্ডার ছিলেন জেনারেল খাদেম। জেনারেল টিক্কা খান ও তার কর্মকর্তারা ৩১তম কমান্ড সেন্টারের তদারকি ও ১৪তম ডিভিশনের কর্মকর্তাদের সহযোগিতা জন্য উপস্থিত ছিলেন।

সিদ্দিক সালিকের ‘নিয়াজীর আত্মসমর্পণের দলিল’ বইটির ৮৪ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা হয়- ‘আকাশে তারার মেলা। শহর গভীর ঘুমে নিমগ্ন। ঢাকার বসন্তের রাত যেমন চমৎকার হয়, তেমনি ছিল রাতটি। একমাত্র হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞ সাধন ছাড়া অন্যসব কিছুর জন্যই পরিবেশটি ছিল চমৎকার।’

পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ট্যাঙ্ক ফার্মগেটের সামনে এলেই পিকেটাররা তাদের প্রতিরোধের চেষ্টা করে। এ সময় জিরো আওয়ারের অপেক্ষা না করেই গুলি চালাতে শুরু করে দেয় তারা। শুরু হয় পৃথিবীর ইতিহাসে জঘণ্যতম গণহত্যা।

স্বাধীনতার ঘোষণা: অপারেশন সার্চলাইট শুরুর ঘণ্টাখানেকের মাথায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তার ধানমন্ডির বাসা থেকে গ্রেফতার করে কর্নেল জেডএ খান ও মেজর বিল্লাল। এরপর তারা তাকে ক্যান্টনমেন্ট নিয়ে যায়। এর তিনদিন পর বঙ্গবন্ধুকে করাচি নেওয়া হয়।

গ্রেফতারের আগ মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু গোপন ওয়ারলেস বার্তায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন- ‘পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আমাদের ওপর আক্রমণ করেছে। ছাত্র-জনতা-পুলিশ-ইপিআর শত্রুর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রাম শুরু হয়ে গেছে। আমি ঘোষণা করছি, আজ থেকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। সর্বস্তরের নাগরিকদের আমি আহ্বান জানাচ্ছি, আপনাদের যার যা আছে তাই নিয়ে দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলুন। সম্মিলিতভাবে শত্রুর মোকাবিলা করুন। এই হয়তো আপনাদের প্রতি আমার শেষ বাণী হতে পারে। আপনারা শেষ শত্রুটি দেশ থেকে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যান।’

পিলখানায় ইপিআর ব্যারাক ও অন্যান্য স্থান থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার লিখিত ঘোষণা ওয়ারলেসের মাধ্যমে সারাদেশে মেসেজ আকারে পাঠানো হয়।


রাতভর নারকীয় গণহত্যা: রাত ১টায় ২২তম বেলুচ রেজিমেন্টের সৈন্যরা পিলখানা ইপিআর হেডকোয়ার্টারে আক্রমণ চালায়। কেন্দ্রীয় কোয়ার্টার গার্ডে কয়েকজন বাঙালি জওয়ান ছিল। কিন্তু তারা পাল্টা আক্রমণের সুযোগ পাননি। এরপর একে একে রাজারবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শাঁখারী বাজারসহ গোটা ঢাকা পরিণত হয় হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের নগরীতে।

রাজারবাগে পুলিশের বাঙালি সদস্যরা তাদের অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। তবে ট্যাংক ও ভারী মেশিনগানের মুখে তাদের প্রতিরোধ শুরুর আগেই ভেঙে পড়ে। গ্যাসোলিন ছিটিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয় পুরো সদর দফতর।

পাকিস্তানি বর্বর সৈন্যরা বাংলাদেশের সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে উচ্চকণ্ঠ কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনকে নির্মমভাবে হত্যা করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আক্রমণ চালিয়ে হত্যা করা হয় দেশবরেণ্য শিক্ষক ও নিরীহ ছাত্রদের। রোকেয়া হলের ছাত্রীদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয় ক্যান্টনমেন্টে।

বস্তির পর বস্তি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। প্রাণ ভয়ে পালাতে থাকা আবাল-বৃদ্ধ-বণিতাকে ব্রাশফায়ারে হত্যা করা হয়। ভস্মীভূত করা হয় দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক সংবাদ, দৈনিক পিপলসহ বহু পত্রিকা অফিস। মিরপুর ও মোহাম্মদপুরের বিহারীরাও বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ঢাকা পরিণত হয় মৃত্যুপুরীতে।

কিন্তু না। এভাবে হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ ও ধ্বংসের মাধ্যমে দমানো যায়নি বাংলাকে। ২৬ মার্চের লাল সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে যেন এক প্রত্যয়ও উদিত হয়; লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে দেশকে স্বাধীন করার। শুরু হয় পৃথিবীর ইতিহাসে এক মহান মুক্তির সংগ্রাম।

Facebook Comments
error: Content is protected !!